‘অরিত্রির আত্মহত্যার জন্য সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী’
প্রকাশিত : ১৭:৪৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৩৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮
ভিকারুননেসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রি`র আত্মহত্যার জন্য সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তার মতে, অরিত্রির আত্মহত্যা দৃশ্যমান। কিন্তু প্রতিদিন অসংখ্য অরিত্রি অদৃশ্য হত্যার শিকার হচ্ছে।
রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা কোন ভাবে এর দায় এড়াতে পারে না। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, অরিত্রির আত্মহত্যা পুরো শিক্ষক সমাজকে যেমন দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায় তেমনি অভিভাবকরাও দায় এড়াতে পারেন না।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভিকারুননেসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রির আত্মহত্যাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: খুবই হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা। পত্রিকায় পড়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অরিত্রির মতো এ বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নানা রকম অস্থিরতা থাকে। অরিত্রি মোবাইল ফোন নিয়ে স্কুলে এসেছিল। স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ে আসা নিষেধ। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্কুলে অরিত্রির শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। শুধু অরিত্রি নয়, স্কুলে অরিত্রির বাবা মাও ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তাতেও শিক্ষকদের মন গলেনি। তারা তাকে বলেছে ‘টিসি নিয়ে যেও’।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: টিসি দিয়ে দিলে কী সমস্যা সমাধা হয়ে যাবে?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: এই ‘টিসি নিয়ে যেও’ কথাটা স্কুলের একটা বিরাট শক্তি। তারা বুঝাতে চায়, তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে জিম্মি। শিক্ষকরা যখন অরিত্রির বাবা মাকে অপমান করে তখন অরিত্রির কাছে আর কোন সান্ত্বনা থাকে না। অরিত্রি বা যে কোন সন্ত্বানের কাছে সবচেয়ে বড় অবলম্বন তাদের বাবা মা। তার জন্যই যদি সেই বাবা মা কোথাও অপমানিত হয় বা কষ্ট পায় তাহলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন যুক্তি তখন থাকে না। মূলত এমন জায়গা থেকে অরিত্রি অসহায় বোধ করেছে ও আত্মহত্যা করেছে। অরিত্রি আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছে। আমরা দেখছি পুলিশ এ ঘটনায় খুব তৎপর। একজনকে গ্রেফতার করেছে। সবাই বলছে ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকরা দায়ী। বিশেষ করে যে তিনজন টিসি দিয়েছে তারা সবচেয়ে বেশী দায়ী। কিন্তু আমার বক্তব্য ভিন্ন।
একুশে টেলিভাশ অনলাইন: আপনার বক্তব্য তাহলে কী?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: আমাদের বর্তমান যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে কৌতুহল বিমুখ, শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ করছে। এখনকার স্কুল ও পাঠ্যপুস্তকগুলো ছেলেমেয়েদের জীবনের স্বাভাবিকতা রক্ষা করতে দিচ্ছে না। সৃজনশীল পরীক্ষার নামে এক অদ্ভৃৎ ব্যাপার ছেলেমেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাবিশ্বে শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ যোগ করলেও আমাদের দেশে শিক্ষার সঙ্গে জুলুম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণী, অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য বোঝা। সেই পরীক্ষা ভালভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারেনা। প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা অস্থিরতার জন্ম দেয় যা অবুঝ শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক কাজে উৎসাহী করে তোলে।
মোবাইল ও ফেসবুকের অপব্যবহার সর্বত্র বাড়ছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মোবাইল ও ফেসবুক আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রচুর সময় অপচয় ঘটাচ্ছে। তাদের জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অরিত্রির আত্মহত্যার সঙ্গে সামাজিক বিশৃঙ্খলা কী জড়িত?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: অবশ্যই। পুরো সমাজব্যবস্থা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পুরো সংস্কৃতি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী হারিয়ে বসে আছে। এ অবস্থায় কোন শিক্ষার্থী যদি অপরাধ করে থাকে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষার্থী বারবার ভুল করবে। তাকে ধীরে ধীরে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষককেই গড়ে নিতে হবে। কেউ সম্পূর্ণ ভাল ছাত্র হয়ে বা ভাল মানুষ হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসেনা। ভাল মন্দ মিলিয়েই আসে। তাকে গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি সামগ্রীক শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। তাহলে কেমন শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: সংবিধানে একমুখী প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের প্রাথমিক শিক্ষা এখন চৌদ্দ ভাগে বিভক্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন শিক্ষা নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক কারও আনন্দ নেই। পরীক্ষায় ভাল ফল করার বাধ্য বাধকতা থেকে কোচিং সেন্টার ও গাইড বুকের প্রসার ঘটছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তরুণদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলছে না। ফলে যারা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী তারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতহীন ভেবে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। আমাদের সিলেবাসে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও সুনাগরিকের গুণাবলী অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষক এখন গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরী করছে। এরচেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে। এর ভেতর দিয়ে ছাত্র- শিক্ষকের নীতি নৈতিকতার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। শ্রদ্ধাবোধ বা স্নেহবোধ কোনটাই এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দোষী শিক্ষকদের ইতোমধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এটা তো ভাল লক্ষণ।
আবুল কাশেম ফজলুল হক: যতোকিছুই করা হোক না কেন যে প্রাণ দিয়েছে সে আর ফেরত আসবে না। তার আত্মত্যাগ তখনই স্বীকৃতি পাবে যদি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢালাওভাবে সাজানো হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব ত্রুটি আছে তা যদি সারানো হয়। ছেলে মেয়েদের আনন্দদায়ক পরিবেশ দিতে না পারলে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবেনা, এমন আত্মহত্যাও রোধ করা যাবে না। গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। আমার মনে হচ্ছে ভিকারুননিসার ঘটনায় আমরা আসল সমস্যা চিহ্নিত করতে পারছি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ছাত্র শিক্ষকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার জন্য মূলত কী দায়ী?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: আগে ছাত্র শিক্ষকের সৌহার্দ্য গড়ে উঠত পাঠ্যপুস্তককে কেন্দ্র করে। কিন্তু এখন সেই জায়গাটি দখল করেছে গাইড ও কোচিং।
দ্বিতীয়ত, সময়ের ব্যবধানে আনুপাতিক হারে বা প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষকদের বেতন বাড়েনি। সমাজে মানসম্মত আর্থিক অবস্থান তারা সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে তারা প্রাইভেট টিউশনির উপর নির্ভর করছে। প্রশ্ন ফাঁশ হওয়ার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন ফাঁস করতে সহায়তা করছে। তার মানে তার স্কুলে কতজন ছাত্র পাশ করল তার উপর স্কুলের সুবিধা বা তাদের সুবিধা নির্ভর করছে। এর ফলে ছাত্র শিক্ষকের পারষ্পরিক নীতি নৈতিকতার অবস্থান নষ্ট হয়ে সেখানে বাণিজ্য ও স্বার্থ জায়গা দখল করে নিয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কেউ কেউ শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দায়ী করছেন। আপনি কী বলেন?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: অভিভাবকরা দায় এড়াতে পারেন না। মোবাইল ও ফেসবুকের পেছনে শিক্ষার্থীরা এত বেশী সময় কেন ব্যায় করছে তা নজরদারীতে রাখা দরকার। আর সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বয়সটা এমন, শিক্ষার্থীরা অনেককিছু বুঝে। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক কিছুর ব্যালেন্স রেখে উঠতে পারেনা। এই সময় ছেলে মেয়েরা ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। তাই অভিভাবকদের উচিত তার সন্তানকে সংযত রাখা ও পরিচালনা করা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
আবুল কাশেম ফজলুল হক: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
এসি
আরও পড়ুন